অভিভাক সচেতনতা ও শিক্ষক মূল্যায়ন: মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা
“তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দিবো।”- এই উক্তিটি নেপোলিয়ন বোনাপার্টের। তিনি ছিলেন ফ্রান্সের এক বিখ্যাত সম্রাট। তিনি শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষাই জাতির উন্নতির চাবিকাঠি।
নেপোলিয়ন বোনাপার্টের এই উক্তিটি চিরন্তন সত্য।কারণ শিক্ষা একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া। শিক্ষা একটি জাতির উন্নতির জন্য অপরিহার্য। একজন শিক্ষিত মা তার সন্তানকে সঠিক শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে একটি শিক্ষিত জাতির ভিত্তি গড়তে পারেন।আমার এই লেখা পড়ে অনেক জ্ঞানী গুণি বলতে পারেন তাহলে শিক্ষকের কাজ টা কি?তাদের বসে বসে বেতন দিয়া লাভ কি?বিবিসির এক জরিপে এসেছে ৬৫% শিক্ষার্থী রিডিং পড়তে পারে না!আবার তাঁরা ১০ম গ্রেড দাবি করে।জেনে বুঝে চাকুরিতে এসে এসব দাবি কেন?থাকতে মন না চাইলে চলে যেতে বলে অনেক মেধাবী আছেন যারা বেকার তাদের চাকুরী দিতে বলেন তাঁদের জন্য আজকের এই কলাম।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে তাদের অধিকাংশের মা- বাবা দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে এবং বেশিরভাগ -নিরক্ষর।আমাদের ডিপার্টমেন্টের দায়িত্বরত ঊধ্বর্তন আমাদের প্রতি যথেষ্ট আন্তরিক ও সহযোগী মনোভাব পোষণ করেন।
তবে হাস্যকর হলেও সত্য, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোন অভাব নেই!একজন সাধারণ বেকার যে একটা প্রাইমারি স্কুলের চাকুরী যোগাতে পারে নি সেও আমাদের জ্ঞান দান করেন।অনেকে বলে থাকেন জিনিস ভালো হলে সেখানে সবাই যাবে।মানে টিচার ভালো হলে স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তি হবে।অনেকে আমাদের ধনবাড়ী এলাকার একটা উদাহরণ দিয়ে থাকেন। আমাদের বিখ্যাত মিষ্টি সূর্যকান্তের।দোকানের অবস্থা একেবারে নড়বড়ে।কিন্তুু মিষ্টি কিনতে সবাই সূর্যকান্তে ই যায়।কারণ মান ভালো।মান ভালো হওয়ার কারণ ভালো কারিগর,দুধ এবং তাঁদের সততা।আমার প্রশ্ন টা এখানে? আমাদের ভালো দুধ আছে, সততা আছে কিন্তুু দ্বিমুখী কানেকশন নেই।কারণ বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যতজন শিক্ষার্থী ভর্তি হয় তাদের অধিকাংশের পিতা মাতা নিরক্ষর এবং অনেকে সন্তান কে তার নানী,দাদীর জিম্মায় রেখে ঢাকায় কাজ করে।আমি এখন পর্যন্ত দুইটা বিদ্যালয়ে কাজ করেছি দুইটার চিত্র একই।যদিও শিক্ষা দান আর মিষ্টি বানানো এক বিষয় না।শিক্ষা একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া।আমি ৫০ মিনিটের শ্রেণি কার্যক্রমে যা পড়লাম তা বাড়ীতে গিয়ে অন্তত কয়েকবার পড়তে হবে লিখতে হবে।নাহলে তারা আয়ত্ত্ব করতে পারবেনা। এটাই খুব স্বাভাবিক।একটা যুক্তবর্ণ শিক্ষার্থী উচ্চারণ ই করতে পারতো না সেটা উচ্চারণ শিখিয়ে ভেঙে ভেঙে পড়িয়ে নতুন একটা লিখে নিয়ে আসতে বললে তিন জনের বেশি লিখে নিয়ে আসে না।কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে বাড়ীতে কেও দেখিয়ে দিতে পারে না।আর শ্রেণিতে আমি প্রতিদিন একটি যুক্তবর্ণ পড়ালে সিলেবাস শেষ করতে একবছরের বেশি সময় লাগবে।তারপর,বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিত হতে পারে না।যখন ধান কাটা বা লাগানোর সময় তখন শিক্ষার্থী উপস্থিতি অনেক কমে যায়।শিক্ষা দ্বিমুখী প্রক্রিয়ার মানে হচ্ছে আমি ইনপুট দিব সেটা প্রক্রিয়া করে আউট পুট দিতে হবে।সচেতন অভিভাবক ছাড়া এটা অসম্ভব।প্রতি দুমাস/তিন মাস অন্তর অন্তর আমরা মা/অভিভাবক সমাবেশ করি সেখানে মা-বাবার চেয়ে দাদী,নানীর উপস্থিতি বেশি দেখা যায়।দ্বিমুখী প্রক্রিয়ার সঠিক প্রয়োগ হলে শিক্ষার মান বাড়বে নিঃসন্দেহে বলা যায়।আরেকটু ভেঙে বলি,আমি একটি বাংলা পাঠ ৫ লাইন রিডিং পড়িয়ে দিলাম।সেটা যদি বাড়ীতে চর্চা না করে পরের দিন কিন্তুু পারবে না।বাড়ীতে চর্চা করানোর দায়িত্ব মা, বাবা বা পরিবারের সদস্যগণের।যতই আপনি ভালো বীজ বপন করেন সঠিক পরিচর্যা না করলে গাছ বেড়ে উঠবে না এবং ফুল ফলও দিবে না।আর যদি ভালো বীজ না হলেও যদি সঠিক পরিচর্যা পায় তাহলে সেখান থেকে ফুল-ফল দুটোই আসবে।
এবার আসা যাক শিক্ষক মূল্যায়নে।এটি দিয়ে আমি দুটি বিষয় বুঝাতে চাই।প্রত্যেক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষক মূল্যায়ন।শিক্ষক মূল্যায়ন হল একটি প্রক্রিয়া যা শিক্ষার্থীদের শেখার এবং সাফল্যের উপর ভিত্তি করে শিক্ষকের কার্যকারিতা পরিমাপ করতে ব্যবহৃত হয়।
শিক্ষক মূল্যায়নের সাথে শ্রেণিকক্ষে এবং বাইরে কর্মক্ষমতা পর্যালোচনা করার জন্য একটি পদ্ধতিগত পদ্ধতি জড়িত। পেশাদারিত্ব বৃদ্ধির জন্য গঠনমূলক প্রতিক্রিয়া প্রদানের জন্য ফলাফল বিশ্লেষণ করা গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে শিক্ষকের কার্যকারিতা, পেশাদারিত্ব এবং শিক্ষার্থীদের শেখার উপর প্রভাব পরীক্ষা করা।আর এই মূল্যায়ন করবে শিক্ষার্থীরা।বছরে অন্তত তিনবার প্রধান শিক্ষক মহোদয় বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে এই মূল্যায়ন করতে পারেন।এতে শিক্ষক তাঁর পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা অব্যহত রাখবেন আর শিক্ষার্থীরা পাবে কাঙ্খিত শিক্ষা যা মানসম্মত শিক্ষা নামে পরিচিত।
অপর পক্ষে শিক্ষকগণের আরেকটি মূল্যায়নের কথা আমি বলতে চাই তা হলো আর্থিক ও সামাজিক মূল্যায়ন।বিষয়টা হয়তো অনেকের ভালো লাগবে না।কিন্তুু তাঁরাও এই প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকের হাত ধরেই অ,আ শিখে আজ অনেক উচ্চাসনে আছেন,আবার অনেকে কুশিক্ষায় বা অশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে প্রাথমিক শিক্ষকগণের পিছনে লেগে আছেন।সেটা আমার বিবেচনার বিষয় না।
আমার শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট এর অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেছেন,”যে জাতি শিক্ষকদের বঞ্চিত করে সে জাতি শিক্ষা পায় না,কেবলই সার্টিফিকেট পায়।”এখানে স্যার বিশেষত প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলেছেন।
যুগ যুগ ধরে প্রাথমিক শিক্ষকদের সাথে শুধু প্রহসন করা হয়েছে।এখন সময় এসেছে প্রাথমিক শিক্ষকদের তাঁদের যোগ্য মূল্যায়ন দেওয়ার।প্রাথমিক শিক্ষকদের তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী ১০ম গ্রেড প্রদান করা উচিত।প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণা সমাজে প্রচলিত আছে।এটা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।এই সেক্টরকে যতটা সম্মানিত করবেন দেশ ততটা সম্মানিত হবে।
শেষ করছি, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট এর অধ্যাপক মজিবুর রহমান স্যারের আরেকটি উক্তি দিয়ে,”শিক্ষকতা অতি মহৎ পেশা।শিক্ষা ও শিক্ষকের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের এই ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি না বদলানো পর্যন্ত শিক্ষা কিংবা শিক্ষকের উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়!”
অনেক আগের একটা রিপোর্ট নিয়ে যাঁরা মাতামতি করছেন আপনারও প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাশ করে এখন বিভিন্ন উচ্চপদস্থ পদে আছেন।অহেতুক সমালোচনা না করে আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে আসুন।প্রয়োজনে আমাদের গাইডলাইন দেন।আমাদের পিছনে ধরে না থেকে বরং সাহযোগী হন। আমরা সকল পরামর্শ গ্রহণ করবো।বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকগণ কেমন মানসম্মত শিক্ষা দিয়ে থাকেন সরোজমিনে এসে দেখে যান,পরামর্শ দিয়ে যান।অথবা অহেতুক সমালোচনা না করে নিজের কাজে মন দিলে সবাই ভালো থাকবে।দেশ ভালো থাকবে।
সোহান শাহরিয়ার
সহকারী শিক্ষক
ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,ধনবাড়ী, টাংগাইল।