লেখকঃ সোলায়মান মোহাম্মদ
সরকার পরিবর্তন হয়েছে। নতুনদের হাতে দায়িত্ব এসেছে। সাধারণ মানুষের আশা ও স্বপ্ন আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সব কিছুই সত্য ও সুন্দরের দিকে ধাবিত হোক এমনই যখন প্রত্যাশা ঠিক তখন ছাত্র ও শিক্ষক সম্পর্কের ছেদ হোক, জাতি বিভ্রান্তির মুখে পড়ুক এমন কিছু বার্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। মেধাবীরা কলঙ্কিত হোক, শিক্ষকরা ভয়ে থাকুক জাতি ধ্বংস হোক মনে হচ্ছে এমন একটা পায়তারা চলমান। শিক্ষকদের জোরপূর্বক পদত্যাগ করানোর খন্ডিত যে ভিডিও প্রকাশ হচ্ছে এতে সারাদেশেই শিক্ষাগুরু বনাম শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা বাজে ধরণের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এমতাবস্থায় আমার ব্যক্তিগত জীবনের একটি ঘটনা শেয়ার করার খুব প্রয়োজন অনুভব করছি।
মাসখানেক আগে বন্ধুর কাছে জানতে পারি আমার একজন শিক্ষক আমার ওপর খুব রেগে আছেন, অসন্তুষ্ট। আমার কোনো আচরণে তিনি বিরক্ত অথবা খুব কষ্ট পেয়েছেন। বদ-দোয়া দিয়েছেন এই টাইপের কিছু। কিন্তু ঠিক কী কারণে আমার শিক্ষাগুরু আমার ওপর বিরক্ত বা কষ্ট পেয়েছেন তা বন্ধু জানাতে পারিনি। যার কাছে ক্লাস ওয়ান থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছি। দুষ্টামির কারণে যেই স্যারের বেতের বাড়ি খেয়ে হাত ফুলিয়ে বাড়ি এসেছি। রাতে প্রচণ্ড জ্বর এসেছে শরীরে। গায়ের জামা খুলিনি, মা জোর করে জামা খোলে দেখে বাহু দুটি ফেঁটে গেছে। মায়ের চোখে জ্বল। বাবাকে বলা মাত্র ঘর থেকে লাঠি নিয়ে আমার দিকে তেড়ে এসেছিলেন। কোন্ অপরাধে মারলো, কী বেয়াদবি করেছে তোমার ছেলে, মাকে এসব নানা প্রশ্ন করতো। ছাত্র জীবনে বেশ দুষ্টু ছিলাম। যেকারণে এভাবে বেত্রাঘাত খেয়েই বড় হয়েছি। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্যারের হাতের পিটনি খেতাম। শিক্ষা জীবন শেষ করেছি। আজকে আমিও এমপিওভুক্ত শিক্ষক। কিছুই হতে পারিনি। তবুও যাই হয়েছি, যতটুকুই হয়েছি এই সকল কিছুর অবদান আমার সেই সব শিক্ষাগুরু এবং মা বাবা’র। যেই স্যারদের শাসন ও আদরে বেড়ে উঠলাম। ভালো মন্দ বুঝতে শিখলাম। সেই স্যারের সাথে কী এমন বেয়াদবি করলাম। মাসভরে চিন্তা করলাম কিন্তু মনে করতে পারলাম না স্যারের সাথে কোথায়, কিভাবে বেয়াদবি করেছি। মনের কষ্ট বাড়তে থাকলো, মনে হচ্ছে বুকে ওহুদ পাহাড় রাখা হয়েছে। দিনদিন বুকের পাহাড় বড় হতে থাকলো। স্যারের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাবো, বড় হয়ে গেছি, মানুষজন দেখলে কী ভাববে এসব চিন্তা মাথায় এসেছে। কিন্তু নিজেকে কোনোভাবেই ক্ষমা করতে পারছি না। বড় ধরণের অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। এক পর্যায়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম। যা হবার হবে, যে দেখার দেখবে। ক্ষমা আমাকে চাইতেই হবে। এই তো এক সপ্তাহ আগে স্যারের কাছে গেলাম ওই বন্ধুর সাথেই। বন্ধুর কাছে কৃতজ্ঞার শেষ নেই। স্যারের সাথে দেখা হলো। কথা বলার এক পর্যায়ে প্রথমে হাত ধরে ফেললাম তারপর পা। স্যার চেয়ারে বসা ছিলেন, পা ধরতে অসুবিধা হলো না। বললাম, স্যার আমি আপনার সন্তান। সন্তান ভুল করলে কি বাবা ক্ষমা করে না? আমার কয়েকদিন যাবৎ মনে হচ্ছে আমি যেনো কবে, কোথায়, কিভাবে আপনার সাথে বেয়াদবি করেছি। আল্লাহর রাস্তে ক্ষমা চাই, যে পর্যন্ত ক্ষমা না করবেন পা ছাড়বো না। চোখের পানি টলমল করছে আমার, বুক ফেঁটে কান্না আসার উপক্রম। স্যার প্রথমে বুঝে উঠতে পারেননি যে আমি তাঁর পা ধরে ফেলবো। মূহুর্তের-ই তো ব্যাপার ছিলো। স্যার হাসিমুখে ক্ষমা করলেন। বললেন, তুমি অবশ্যই আমার সন্তান। তারপর অনেক কথা। স্যারের ওখানে দীর্ঘক্ষণ বসলাম। বুকের পাহাড়টা নিমিষেই উধাও। মনে ভীষণ খুশি খুশি লাগছে। আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করছে। আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করলাম। স্যারের সাথেই মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম। মনে মনে কিছু ভালো কাজের প্রতিজ্ঞা করলাম। এনিওয়ে, আমার সকল শিক্ষা গুরুর কাছেই ক্ষমা চাই। দেখা হলে হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নিবো। জানি না, হয় তো ভুল বেয়াদবি করেছি!
পাঠকবন্ধুরা এই কথাগুলো কখনই বলতাম না, পত্রিকায় লিখার প্রশ্নেই আসতো না। কিন্তু ওই যে লেখাটা শুরু করেছিলাম যে বিষয়টিকে নিয়ে। কাজেই বর্তমান প্রেক্ষাপটে না লিখে থাকতে পারলাম না। এবার আসি মূল বিষয়ে। বিগত সরকারের সময় যারা দলদাস হয়ে প্রধান শিক্ষক কিংবা প্রিন্সিপাল হয়েছে। লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চেয়ারে বসেছে। দলের পদ পদবী দখল করে, ক্লাস বাদ দিয়ে মিটিং মিছিল করেছে। দলের নেতাদের পা চাটতে চাটতে জুতার তলি খসিয়ে ফেলেছে। সদ্য বিদায় হওয়া সরকার নির্বিচারে সন্তানদের হত্যার হুকুম দিয়েছে অথচ তারা নিরব ছিলো। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, সন্তান খুন হওয়ার পরেও যে বাবা কিংবা শিক্ষক নিরব থাকে সে কী করে শিক্ষক হয়, জাতী গড়ার কারিগর হয়? ইনফ্যাক্ট এমন ব্যক্তি আমার শিক্ষক না, তাকে আমি শিক্ষক হিসেবে মানিও না। তারা শিক্ষকতা করেনি, করেছে চাকরি। নির্দিষ্ট একটি দলের গোলামি করে জাস্ট স্কেল পরিবর্তন করে বেতন বাড়িয়েছে। আর কিছু না। তবে এটাও বলে রাখি, এদের চাকরি চলে যাক বা পাবলিকলি হেনস্তার শিকার হোক সেটি আমি ডেফিনেটলি চাই না। কিন্তু এমন ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকাও কাম্য নয়। যদিও এসবের একটি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আছে। তাছাড়া তাদের সংসার আছে, সন্তান আছে। সন্তানের কাছে বাবা-মা খাটো হোক তা আমি সজ্ঞানে কখনই সমর্থন করি না। সম্প্রতি কলেজের প্রিন্সিপালকে জোর করে পদত্যাগ করানোর যে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। পরবর্তীতে সংবাদমাধ্যমে জানতে পারি সেই শিক্ষক স্ট্রোক করে মৃত্যুবরণ করেছেন। এভাবে জোর করে পদ থেকে সরানো অমানবিক, লজ্জার। এমনটা কখনোই প্রত্যাশা করি না। বিগত সরকারের আমলে কোনো শিক্ষক দলদাস হয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ম শৃঙ্খলা বহি:র্ভূত কাজে জড়িয়ে থাকলে এবং তা প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নিয়ম অনুযায়ীই চাকরি থেকে অপসারণের ব্যবস্থা হওয়া জরুরী। অবশ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপনও দিয়েছে।
লেখা শেষ করছি, আমার যিনি শিক্ষক যার কথা বললাম পূর্বে। তাঁদের মতো মানুষের পা ধরতে আমার বা আমাদের লজ্জা থাকতে নেই, লাখো মানুষের সামনেই ধরতে পারি। সারা জীবন এমন শিক্ষকের জুতা মাথায় নিয়ে ঘুরতে পারি। বিশ্বাস করি এ সময়ের মেধাবীরাও তাদের মাথায় করেই রাখবেন। পৃথিবীর সকল শিক্ষকদের শ্রদ্ধা জানাই।
সোলায়মান মোহাম্মদ
শিক্ষক ও কলাম লেখক
০১৭১২৪১২৬২৫